পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সহিংসতার বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, “সেখানে যৌথ অভিযান চলছে। শিগগিরই পরিস্থিতি শান্ত হবে।”
শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সকালে রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, মৎস্যজীবী লীগের ঈদ উপহার বিতরণ অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
“পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোট একটি গ্রুপ সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছে। এই গ্রুপগুলো রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িতে নেই। শুধু বান্দরবানে আছে। এই গোষ্ঠীর কিছু তরুণ অস্ত্রশস্ত্রসহ মহড়া দিচ্ছে;” যোগ করেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি আরো বলেন, যে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথ অভিযান চালাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, অচিরেই পরিস্থিতি শান্ত হবে।
এই গোষ্ঠীর সশস্ত্র তৎপরতার ঘটনায় পুরো পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত হবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই বলে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
খাগড়াছড়িতে নিরাপত্তা জোরদার
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির পর, খাগড়াছড়ির সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। শুক্রবার (৫ এপ্রিল) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো.সহিদুজ্জামান।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও বিভিন্ন উপজেলার সদরের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। তবে বান্দরবানের ব্যাংক ডাকাতির পর থেকে সর্তক অবস্থান নেয়া হয়েছে। আর, নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তারা।
খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সোনালী ব্যাংকের এজিএম সমর কান্তি ত্রিপুরা বলেন, “ঘটনার পর ব্যাংকে ভার্চুয়ালি সভা হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আমাদের ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।”
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক খাগড়াছড়ি শাখার ব্যবস্থাপক দেবাশীষ ত্রিপুরা বলেন, “আমাদের কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। যেহেতু জেলা শহরে আছি, তাই নিরাপত্তা নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই আমাদের। তবে সতর্ক আছি।”
নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান দেবাশীষ ত্রিপুরা। বলেন, “এখন দুই জন গানম্যান দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কোনো সংকট আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে।”
ডাচ বাংলা ব্যাংক খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ব্যবস্থাপক মো.নুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, সকাল থেকে একাধিকবার পুলিশ সদস্যরা ব্যাংক পরিদর্শন করেছে। সরকারিভাবে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংকট নেই। এছাড়া ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, “আমরা সবাইকে বার্তা দিয়েছি তারা যেন সতর্ক থাকে। পুরো জেলায় পুলিশি নিরাপত্তার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া, যতটুকু নিরাপত্তা দরকার ততটুকু নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”
বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতির প্রেক্ষাপটে খাগড়াছড়ির সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মো.সহিদুজ্জামান।
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে পুলিশের সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া জেলার কোর কমিটির বৈঠকে ব্যাংকের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে।"
পরিবারের কাছে ব্যাংক ব্যবস্থাপক
অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করার পর, বান্দরবানের রুমার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
শুক্রবার (৫ এপ্রিল) র্যাব সদর দপ্তরের মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ইমরান খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করার পর, বান্দরবানের রুমার সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এর আগে বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) রাতে র্যাব সদস্যরা মধ্যস্থতার মাধ্যমে বান্দরবান জেলার বাথেলপাড়া এলাকা থেকে ব্যাংক ব্যবস্থাপক নিজামকে উদ্ধার করে।
বৃহস্পতিবার বিকালে নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী নাজমুল নাহার জানান, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) তার পরিবারের কাছে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে।
গত মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ভল্ট থেকে দেড় কোটি টাকা লুটপাটের চেষ্টা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্র। টাকা নিতে না পেরে, ব্যাংকের রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজামকে অপহরণ করে তারা।
বুধবার বান্দরবানের থানচি উপজেলায় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে বিছিন্নবাদীরা।
থানচি থানায় হামলার চেষ্টা
বান্দরবানের থানচি উপজেলাতে, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এই ঘটনা সহিংসতার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিকে তুলে ধরে।
বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) রাত পৌনে ৮টার দিকে থানচি বাজারের কাছে গুলি বিনিময় শুরু হয়। সশস্ত্র দলটি থানচি থানায় হামলার চেষ্টা করে বলে খবর পাওয়া গেছে। এসময় পুলিশও প্রায় ৫০০ রাউন্ড গুলি চালিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছে।
থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিমউদ্দিন সংঘর্ষের কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রাতের অন্ধকারের কারণে হামলাকারীদের শনাক্ত করতে অসুবিধা হয়েছে। থানচি বাজারের প্রান্তে বিজিবি ক্যাম্প ও সেনা তল্লাশি চৌকির নিকটবর্তী এই থানায় সংঘর্ষ হয় বলে জানান তিনি।
থানচি বাজার কমিটির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামল্লাই ম্রো জানান, যৌথবাহিনী ও কেএনএফ জঙ্গিদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মামুন জানান, কেএনএফ সদস্য, পুলিশ ও বিজিবির মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। তবে হতাহতের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ব্যাংক ডাকাতি
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকে অস্ত্রের মুখে দেড় কোটি টাকা ও ১০টি অস্ত্র লুট করে কেএনএফ আগ্রাসী তৎপরতা শুরু করে।
উপরন্তু, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে একটি মসজিদে নামাজের সময় অপহরণ করে। পরে বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয় যে ব্যাংকের ভল্ট থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি বা খোয়া যায়নি।
এর পর, বুধবার বিকালে থানচি উপজেলায় কেএনএফ জঙ্গিরা হামলা চালায় এবং দুটি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় র্যাব-৭ এর কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন এবং অপহৃত সোনালী ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধারের ঘোষণা দেন।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)
বান্দরবানে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ২০২২ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। এ সময় তারা ফেসবুকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি করে।
এদিকে কেএনএফ পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিপূর্বে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০২৩ সালে অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও র্যাব
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত। এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।