বাংলাদেশ: রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আর্থিক চাপে শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত

রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আর্থিক চাপে শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত

রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। রোজার মাসে পরিবার ভেদে গড়ে মাসিক ব্যয় বেড়েছে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এর ফলে, আর্থিক চাপে পড়েছে শহুরে সীমিত আয়ের মানুষ।

বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন কাজী শরিফুল হক। তিনি ইউএনবিকে বলেন, রমজানে ইফতার ও সেহরির সময় যে খাবার খাওয়া হয়, তাতে অন্য সময়ের থেকে মাসে খাবার খরচ বেশি হয়। ফলে, ফল, গরুর মাংস ও খাসির মাংসের মতো খাদ্য পণ্যে ব্যবহার কমে যায়।
শরিফুলের সঙ্গে কথা হয় রাজধানী ঢাকার প্রধান কাঁচাবাজার কারওয়ানবাজারে। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন পুরো সপ্তাহের বাজার করতে।

তিনি বলেন, তার অভিজ্ঞতায় বেশিরভাগ পণ্যের দাম কেজিপ্রতি ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রমজান মাসের শুরুতেই মাছের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, মুরগির মাংস ১৫ থেকে ২০ টাকা, ছোলা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কেজিতে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

সরকার নির্ধারিত মূল্যে খেজুর পাওয়া যায় না বলে জানান শরিফুল। তিনি বলেন, আপেল, মাল্টাসহ কিছু ফল প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে।

শরিফুল আরো জানান, চাল ও ভোজ্য তেলের দাম এখনো স্থিতিশীল। তবে সংসার খরচ শুধু বাজার-খরচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ওষুধ (স্বাস্থ্য), পানির বিল, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ খরচ, বাড়ি ভাড়াসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।

বিভিন্ন বিল ও দ্রব্যমূল্য শহরের মধ্যবিত্তকে চেপে ধরছে, বিশেষত শরিফুলের মতো সীমিত আয়ের মানুষকে। সর্বশেষ দুই বছর আগে তার কর্মস্থলে বেতন বাড়ানো হয়েছিলে বলে জানান তিন। এই দুই বছরে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে। এ কারণে, আর্থিক চাপে হতাশা বোধ করেন তিনি। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শরিফুলের মতো অবস্থা অধিকাংশ শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের।

২০০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ড বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে 'স্কুইজড মিডল' শব্দটি চয়ন করেছিলেন।

অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান ২০১১ সালে শব্দটিকে তাদের 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার' হিসেবে বিবেচনা করে। এর সংজ্ঞায় বলা হয়, "এটি এমন একটি শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত সমাজ, যাদের আয় নিম্ন বা মধ্যম স্তরের। এরা মুদ্রাস্ফীতি, মজুরি হিমায়িত ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় খরচ কমাতে বাধ্য হয়।”

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ইউএনবিকে বলেন, মুদ্রাস্ফীতি ও এলোমেলোভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার উঠানামা (আমদানি পণ্যের দামকে প্রভাবিত করে) শহরাঞ্চলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে; কারণ, শহুরে মানুষ সরবরাহ চেইনের ওপর নির্ভরশীল।

ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, গ্রামাঞ্চলে একটি পরিবারের ভোগ করা পণ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় নিজের জমিতে, যা শহরে হয় না। মধ্যবিত্তদের বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নগর জীবনকে আরো মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।

“শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম নয়; স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয় ও নানা ধরনের (ইউটিলিটি) বিল বেড়েছে।কোভিডের প্রাদুর্ভাব (২০২০-২০২২) কমে যাওয়ার পর, পরিবারের আয়, মূলত বেতন বাড়েনি। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে পড়েছেন চাকরিজীবীরা;” বলেন ড. ফাহমিদা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে টানা ২২ তম মাস বাংলাদেশে গড় মজুরি প্রবৃদ্ধি ছিলো মুদ্রাস্ফীতির হারের অনেক নিচে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, আমদানি করা হোক বা দেশে উৎপাদিত হোক; সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, “চাকরিজীবীদের আয় না বাড়লেও, অন্যদের পাশাপাশি তাদেরও ব্যয় বেড়েছে। আর এই ব্যয় বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট আয়ের গোষ্ঠীর জন্য একটি বিশেষ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

“যদি যৌক্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে দাম বাড়ানো হয়, অর্থাৎ বাজারের মৌলিক বিষয়গুলো মেনে চলা হয়, তবে, এই বোঝা নিয়ন্ত্রণযোগ্য থাকবে। কিন্তু, যখন স্বেচ্ছাচারিতা করে, তখন জনগণের পক্ষে এটি খুব কঠিন হয়ে যায়;” বলেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান।

এবিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরো মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। “কারণ, দেশে মূল্যবৃদ্ধি, মজুতদারি ইত্যাদির বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে আইন রয়েছে;” বলেন ক্যাব সভাপতি।