ভারতের সংসদে অনাস্থা বিতর্কের প্রথম দিন: প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা, 'ইন্ডিয়া'-এ ভাঙনের চেষ্টা, জোটসঙ্গী মুখ্যমন্ত্রীকে ইডি-র তলব

ভারতের সংসদে অনাস্থা বিতর্কের প্রথম দিন: প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা, 'ইন্ডিয়া'-এ ভাঙনের চেষ্টা, জোটসঙ্গী মুখ্যমন্ত্রীকে ইডি-র তলব

বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদের অনাস্থা বিতর্কে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা

মঙ্গলবার ৮ অগাস্ট সংসদে অনাস্থা বিতর্কে বর্ষীয়ান তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় ছিলেন তার পরিচিত ধারালো ও বুদ্ধিদীপ্ত বক্তৃতা নিয়ে। লোকসভাতে এর আগেও বহুবার সৌগত রায়ের বক্তৃতা নিয়ে তারিফ হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে।

এদিন অনাস্থা বিতর্কে অংশ নিয়ে সৌগত রায় শুরুতেই বলেন, "নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনও বিরোধ নেই। আমি ওর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে এই তর্কে প্রশ্ন তুলব না, যদিও তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। আমি একবারও গুজরাত দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলব না। আমি বিবিসি-র ডকুমেন্টারির কথাও বলব না। বরং জুলিয়স সিজারের ব্রুটাসের মতো বলতে চাই যে মোদীকে কম ভালবাসি না, তবে ইন্ডিয়াকে আরও বেশি ভালবাসি।"

সৌগতবাবুর শুরুর এই মন্তব্য মুহূর্তেই নজর কেড়ে নেয়। সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে সৌগতবাবু বলেন, "ইনি কেমন প্রধানমন্ত্রী জানি না। দেশের একটি রাজ্য জ্বলছে। কত মানুষ মারা যাচ্ছে। মা বোনেদের ইজ্জত অরক্ষিত হয়ে পড়েছে সেখানে। আর প্রধানমন্ত্রী পাপুয়া নিউ গিনি থেকে শুরু করে কোন কোন দেশে সব ঘুরে বেড়াচ্ছেন।"

এদিন সৌগত রায়ের বক্তৃতা দেওয়ার আগে অনাস্থা বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। সিঙ্গুর কাণ্ডে ও বাংলায় তৃণমূল সরকার গঠনে বিজেপির কত অবদান ছিল তা সৌগতবাবুদের স্মরণ করাতে চেষ্টা করেছিলেন নিশিকান্ত।

সৌগতবাবু জবাবে বলেন, "নিশিকান্তর কথা ধর্তব্যের মধ্যে ধরছি না। উনি মন্ত্রী হতে চান। তাই মোদীকে খুশি করতে মরিয়া। বরং আমি বলতে চাই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা। যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নরেন্দ্র মোদী শেষ করে দিয়েছেন। বাংলায় বিজেপি ভোট সাফল্য পায়নি। তাই একশ দিনের কাজের টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র। আবাস যোজনার ৮,২০০ কোটি টাকাও আটকে রেখেছে।"

পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতি, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট, আদানি প্রসঙ্গ, বিরোধী শাসিত রাজ্যপালদের অতিসক্রিয়তা—ইত্যাদি সবই ধরে ধরে এদিনের বিতর্কে টেনে আনেন এই তৃণমূল সাংসদ।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এদিনের বক্তৃতায় রাহুল গান্ধীর প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছেন সৌগত রায়। তিনি বলেন, "রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ ফেরানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আস্থা জানাচ্ছি। আর এই সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাচ্ছি। ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদী আর জিততে পারবেন না। কোনওভাবেই না।"

অনাস্থা বিতর্কে সরকার পক্ষের প্রথম বক্তৃতায় 'ইন্ডিয়া' জোটে কংগ্রেস-তৃণমূলের সঙ্গে থাকাকে কটাক্ষ

মঙ্গলবার লোকসভায় অনাস্থা বিতর্কে সরকারের দিক থেকে প্রথম তর্কে নিশিকান্ত দুবে বোঝাতে চাইলেন, 'ইন্ডিয়া' জোটের জোটসঙ্গী কংগ্রেস কখনও তৃণমূলের ভাল চায়নি। বিজেপি চেয়েছে।

জাতীয় স্তরে কংগ্রেস ও তৃণমূলের বনিবনার অভাবের সুবিধা গত ৯ বছর ধরে পেয়েছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি। ২০১৪ সালের পর থেকে লাগাতার বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গিয়েছে, সংসদে কক্ষ সমন্বয়ে তৃণমূল, কংগ্রেসের পাশে থেকেও নেই। কখনও ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থেকে তৃণমূল মোদী সরকারের সুবিধা করে দিয়েছে। কখনও কংগ্রেস জেপিসি গঠনের দাবিতে সংসদ অচল করলে তার আপত্তি জানিয়েছে তৃণমূল।

কিন্তু এই প্রথম সংসদে ও সংসদের বাইরে কংগ্রেস, তৃণমূলের মধ্যে যোগসূত্র মজবুত হয়েছে। বিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া'-তে কংগ্রেস-তৃণমূল, রাহুল-মমতা রসায়ন এখন মজবুত বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। যেখানে মমতাকে মর্যাদা দিচ্ছেন সনিয়া গান্ধী, আবার মমতা বলছেন, "আমাদের প্রিয় রাহুল।"

এদিন সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে বিজেপির পক্ষ থেকে প্রথমে বক্তৃতা দিয়েছেন নিশিকান্ত দুবে। তার তর্কে নিশিকান্ত তৃণমূলের সাংসদদের উদ্দেশে বলেন, "আপনারা কেন কংগ্রেসের সঙ্গে রয়েছেন? বাংলায় আপনাদের সরকার গঠনের নেপথ্যে আমাদেরও কিছু অবদান ছিল। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে রাজনাথ সিংহ-সহ বিজেপির নেতারা আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বরং কংগ্রেসই নারদ কাণ্ড, সারদা ইত্যাদি করে আপনাদের পিছনে লেগেছিল।"

প্রসঙ্গত পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানায় সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন অনশনে বসেছিলেন, তখন রাজনাথ কলকাতায় এসেছিলেন। তখন বিজেপির সভাপতি ছিলেন রাজনাথ সিং। তবে নারদ কাণ্ড ফাঁস হয়েছিল, ২০১৬ সালে। পরবর্তীকালে সেই কাণ্ডের জন্য তৃণমূলেরই প্রাক্তন সাংসদ কেডি সিংয়ের বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছিল। যে কেডি সিংয়ের সঙ্গে বিজেপিরও ঘনিষ্ঠতা ছিল।

তবে সারদা কাণ্ড ইউপিএ জমানায় হয়েছিল। সেই সময়ে সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান ও সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁদের মামলার ভিত্তিতেই চিটফান্ড কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এই তদন্তের সময়ে অসমের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল।

নিশিকান্তের বক্তব্য নিয়ে তৃণমূল কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি বলেন, "ইন্ডিয়া জোটকে যে বিজেপি ভয় পাচ্ছে তা পরতে পরতে বোঝা যাচ্ছে। তাই প্রথম বক্তৃতা থেকেই ফাটল ধরানোর চেষ্টায় নেমেছে।"

অনাস্থা বিতর্কের মধ্যে 'ইন্ডিয়া' জোটের মুখ্যমন্ত্রীকে ইডির তলব

সংসদে মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া অনাস্থা বিতর্কে ইন্ডিয়া জোট-সহ বিরোধীরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআই, আয়করের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির অপব্যবহার নিয়ে সরব হয়েছেন। এদিকে মঙ্গলবারই 'ইন্ডিয়া' জোটের অন্যতম শরিক ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা তথা ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে নোটিস ধরাল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। আগামী ১৩ অগাস্ট মুখ্যমন্ত্রীর রাঁচির অফিসে তাকে তলব করা হয়েছে।

ইডি সূত্রের খবর, রাঁচিতে একটি জমির বেআইনি হাতবদলে তারা হেমন্তের যোগ পেয়েছে। প্রসঙ্গত এই মামলায় ইডি ব্যবসায়ী এবং জমি দফতরের অফিসারসহ ১৩ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের দু’জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। এছাড়া অভিযুক্তদের বেশ কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী বলে ইডির দাবি।

উল্লেখ্য, হেমন্তের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই খনি দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে ইডি ও সিবিআই। দুই এজেন্সিই গত বছর ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে দফতরে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এবার নতুন মামলায় তলব করল ইডি।

খনি দুর্নীতির মামলায় আবার হেমন্তের বিরুদ্ধে লাভদায়ক পদে থাকার অভিযোগ উঠেছে। তিনি একটি পারিবারিক খনি কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর। অভিযোগ, লাইসেন্সে উল্লেখিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে খনিজ উত্তোলন করে বিপুল টাকা করেছেন হেমন্ত। আবার নির্বাচনের সময় এই কোম্পানির নাম হলফনামায় উল্লেখ করেননি।

বিরোধীদের একাংশের বক্তব্য, ইডিকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নোটিস ধরানো হয়েছে হেমন্তকে। সংসদে অনাস্থা বিতর্কে বিরোধীরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ তুলেছেন ইডি-সিবিআইয়ের অপব্যবহার নিয়ে। মোদী চাইছেন, অনাস্থা বিতর্কে নিজেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তুলে ধরতে। হেমন্তকে ইডির নোটিস ধরানোর প্রসঙ্গটিও বুধবার ৯ অগাস্ট অনাস্থা বিতর্কের জবাবি ভাষণে উল্লেখ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না রাজনৈতিক মহল।