সময়টা ছিল ২০০৪-এর মে মাসের মাঝামাঝি। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতায় আসছে কংগ্রেস নেতত্বাধীন ইউপিএ। দেশবাসীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন সনিয়া গান্ধী। অর্থাৎ কংগ্রেস সভাপতির পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন এমন একজন যিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নন।
কিন্তু ২০০৪-এর ১৭ মে সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত বদলে গেল। সনিয়া গান্ধী নিজেই ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী হবেন মনমোহন সিং। সেই সঙ্গে জানালেন সিদ্ধান্ত বদলের কারণ। সনিয়া বলেছিলেন, "অন্তরাত্মার অনুমোদন নেই, তাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে আমি অপারগ।"
রাজীব-পত্নীর প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার বিষয়ে এতদিন তাঁর নিজের মুখে বলা কথাই জানত দেশবাসী। যদিও প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী তথা গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠজন নটবর সিং এবং লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পরে মিডিয়াকে বলেছিলেন, সম্ভবত সন্তানদের মুখ চেয়েই সিদ্ধান্ত বদল করেছেন কংগ্রেস সভাপতি।
সাংবাদিক নীরজা চৌধুরী তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘হাউ প্রাইম মিনিস্টার ডিসাইড’-বইয়ে সনিয়ার সিদ্ধান্ত বদলের সেই মুহূর্তটির কথা বর্ণনা করেছেন। সেদিন, অর্থাৎ ২০০৪-এর ১৭ মে বিকালে ১০ জনপথের বাংলোর একটি ঘরে বৈঠক করছিলেন মনমোহন সিং, নটবর সিং এবং গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ সুমন দুবে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। আচমকাই সেই ঘরে প্রবেশ করেন রাহুল গান্ধী। তিনি সনিয়াকে বলেন, "মা, আমি চাই না তুমি প্রধানমন্ত্রী হও। কারণ, আমি তোমাকে হারাতে চাই না। দেশ বিরোধী শক্তি আমার ঠাকুমাকে কেড়ে নিয়েছে। বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। তোমাকেও কেড়ে নেবে।"
উত্তেজিত দাদাকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন প্রিয়ঙ্কা। রাহুল সনিয়াকে বলেন, "তুমি যদি আমার কথা উপেক্ষা করো তাহলে আমি হয়তো খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব। আমি তোমাকে হারাতে চাই না মা।"
সাংবাদিক নীরজা চৌধুরী তাঁর বইয়ে লিখেছেন, এই বর্ণনা তিনি নটবর সিংহের মুখ থেকে শুনেছেন। এই ঘটনার আগের দিনই এক নৈশভোজের আসরে কংগ্রেসের তরফে ইউপিএ শরিক নেতাদের জানানো হয় সনিয়াই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। সিপিএম নেতা হরকিষেন সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, আরজেডি সুপ্রিমো লালুপ্রসাদ, সিপিআইয়ের এবি বর্ধন, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদবেরা কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। বস্তুত শরিক নেতারা বুঝতে পারছিলেন সনিয়া প্রধানমন্ত্রী না হলে কংগ্রেসের মধ্যেই সমস্যা দেখা দেবে। তাঁরাও চাইছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রীই সরকারের দায়িত্ব নিন। সনিয়াকে তাঁরা শুভেচ্ছাও জানান।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, দলের তরফে তাঁর নাম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণার মুহূর্তে সনিয়া ছিলেন নিরুত্তর। তিনি হলঘরের এক কোনায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংহের সঙ্গে একান্তে কথা বলছিলেন। ভিপি-র সঙ্গে রাজীবের সম্পর্ক সবচেয়ে তলানিতে ঠেকেছিল। রাজীবের সরকারের বিরুদ্ধে বোফর্স কামান দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মন্ত্রীত্ব এবং কংগ্রেস ছেড়েছিলেন ভিপি। কংগ্রেস নেতারা তাঁর সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু সনিয়া বিবাদ ভুলে সেদিন সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মতামত শুনছিলেন। নৈশভোজে সনিয়ার হয়ে নটবর সিং ভিপিকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু পরদিনই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন সনিয়া গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী না হয়ে মনমোহন সিং-এর নাম প্রস্তাব করেন।