ভারতের উত্তর-পূর্বে মণিপুরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে বলে বিরোধীদের পাশাপাশি এবার সে রাজ্যের শাসক দল বিজেপির নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কেরাও সরব হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং-এর অপসারণ দাবি করেছে বিরোধীরা। প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, পাহাড়ি রাজ্যটির প্রকৃত অবস্থা কেমন তা শুধু গত তিন মাসে রুজু হওয়া হাজার ছয়েক এফআইআর থেকেই স্পষ্ট।
জানা যাচ্ছে, শুধু বিপুল সংখ্যায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে তাই-ই নয়, মণিপুরে পুলিশের কাছে রুজু হয়েছে রেকর্ড সংখ্যায় ‘জিরো এফআইআর’। ভারতে অতীতে কোনও রাজ্যে কখনও এত সংখ্যায় জিরো এফআইআর দায়ের হয়নি বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা যাচ্ছে।
ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৫৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধে পুলিশ দণ্ডবিধির নির্দিষ্ট ধারায় মামলা দায়ের করতে বাধ্য ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট বা এফআইআর-এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ অভিযোগকারীর বয়ানের ভিত্তিতে পুলিশকে অভিযোগ নথিভুক্ত করতে হবে। একাধিক মামলায় হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট এফআইআর দায়েরকে বাধ্যতামূলক করেছে। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর প্রতিটি থানায় প্রতিদিন দায়ের হওয়া এফআইআর-এর কপি অধীনস্ত পুলিশ থানার ওয়েবসাইটে আপলোড করাও বাধ্যতামূলক হয়েছে।
অনেক সময়ে অপরাধের এলাকাভুক্ত থানায় অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ থাকে না। ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী যে কোনও থানায় অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ প্রথম থেকেই ছিল। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই থানার বিরুদ্ধে অভিযোগকারীকে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পর গঠিত বিচারপতি ভার্মা কমিশন জিরো এইআইআর বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করলে সংশ্লিষ্ট মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সব রাজ্যকে তা অনুসরণ করতে বলে। যদিও এখনও বহু থানা ঘটনাস্থল বা অপরাধের এলাকা তাদের থানার অধীনে নয়, এই যুক্তিতে অভিযোগকারীকে ফিরিয়ে দেয়।
গত ৩ মে মণিপুরে জাতি দাঙ্গা শুরুর পর পরিস্থিতি এমন হয় যে স্থানীয় থানায় যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। হামলার মুখে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সেখানকার স্থানীয় থানায় পরে অভিযোগ দায়ের করেন তাঁরা। জিরো এফআইআর-এ নিয়ম হল, এফআইআর-এর কপি সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। ত্রাণ শিবিরে গিয়েও পুলিশ অভিযোগ নথিভুক্ত করে।
মণিপুরের চলতি অশান্তিতে বারে বারেই সামনে এসেছে কুকি প্রধান চূড়াইচাঁদপুর এবং মৈতেই বহুল বিষ্ণুপুরের কথা। সরকারি সূত্রের খবর, চূড়াইচাঁদপুরে ১৭০০ জিরো এফআইআর দায়ের হয়েছে। ধরে নেওয়া যায় মেইতেই বহুল এলাকায় হামলার শিকার হওয়া কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে এসে এই এলাকায় আশ্রয় নেওয়ার পর স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। লাগোয়া কাংপোকপি থানায় দায়ের হয়েছে প্রায় ৮০০ জিরো এফআইআর। অন্যদিকে, ১২৫০টি জিরো এফআইআর দায়ের হয়েছে মেইতেই সম্প্রদায় বহুল বিষ্ণুপুর থানায়।
কিন্তু মণিপুরের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কুকি সম্প্রদায়ের পুলিশ কর্মী মেইতেইদের এলাকায় যেতে সাহস করছেন না। উল্টো চিত্র মেইতেই সম্প্রদায়ের পুলিশ, সরকারি কর্মীদের। তদন্তকারীরা অনেক ক্ষেত্রে কয়েকজন অভিযোগকারীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে মৌখিক বক্তব্য নথিভুক্ত করেছেন। ফলে অভিযোগের নিষ্পত্তি কবে হবে অভিযোগকারী ও তদন্তকারী কেউই বোঝার মতো পরিস্থিতিতে নেই।