মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস বলেছে, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের উচিত ওয়াং কেলিয়ানে আবিষ্কৃত রোহিঙ্গাদের গণকবরের বিষয়ে একটি নতুন তদন্ত শুরু করা এবং মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের শনাক্তকরণ, তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই অবহেলার প্রমাণ পাওয়া কর্মকর্তাদের বিচার করা।
বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সংস্থাটি এ দাবি জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে, মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পারলিসের একটি আদালত মালয়েশিয়ার অ্যান্টি-ট্রাফিকিং ইন পার্সনস এবং অ্যান্টি স্মাগলিং অব মাইগ্রেন্টস অ্যাক্টের অধীনে অপরাধের জন্য থাইল্যান্ডের ৪ জন নাগরিককে অভিযুক্ত করেছে, যাদেরকে থাই সরকার মালয়েশিয়া সরকারের কাছে প্রত্যর্পণ করেছে।
ফরটিফাই রাইটস ও মালয়েশিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সুহাকাম–এর ২০১৯ সালের এক তদন্তে জানা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের পাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই ঘটনা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ গঠন করেছে৷
মালয়েশিয়ার একটি রাজকীয় তদন্ত কমিশন (আরসিআই) পরবর্তীতে ২০২০ সালে দেখতে পায় যে, মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের পাচার এবং ২০১৫ সালে ওয়াং কেলিয়ানে আবিষ্কৃত গণকবরগুলো রোধ করতে পারতেন।
অভিযোগগুলো ২০১৫ সালে মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ায় জাতিগত নিধনের সময় রোহিঙ্গাদের পাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বৃহস্পতিবার জারি করা এক বিবৃতিতে, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে যে, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ তাদের থাই প্রতিপক্ষের কাছে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রত্যর্পণের অনুরোধে নাম দেওয়া ১০ জনের মধ্যে চারজন প্রত্যর্পিত ব্যক্তি।
প্রত্যর্পিত ওই চার ব্যক্তি হলেন—জেহপা লাপি-ই (৫৬), সোমফোন এ-ড্যাম (৫১), অরুণ কাইওফাইনোক (৩০) এবং আমরি নেসালেহ (৫৮)। তারা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এই সিন্ডিকেট ২০১২ ও ২০১৫ সালের মধ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় আনুমানিক ১ লাখ ৭০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুদের পাচার করেছিল।
বহু বছরের তদন্ত এবং বেঁচে যাওয়া ও অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া ২৭০টিরও বেশি বিবরণের ওপর ভিত্তি করে ফরটিফাই রাইটস ও সুহাকাম ২০১৯ সালে তাদের ১২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথি অন্তর্ভুক্ত করেছে।
ফরটিফাই রাইটস ও সুহাকাম–এর প্রতিবেদন ব্যাপক ও পদ্ধতিগত অপব্যবহার উন্মোচন করেছে। যার মধ্যে রয়েছে কারাবাস, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, বঞ্চনার মাধ্যমে মৃত্যু, ধর্ষণ এবং স্থল ও সমুদ্রে হত্যা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে যে, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ প্রমাণ নষ্ট এবং নিহতদের লাশ উত্তোলনে বিলম্ব করে বিচার বাধাগ্রস্ত করেছে। এই ফলাফলগুলোর মধ্যে কিছু ফরটিফাই রাইটস ও সুহাকামের নথিভুক্ত অপরাধের তদন্ত এবং জবাবদিহিতা চাওয়ার জন্য ২০১৯ সালে মালয়েশিয়ান সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আরসিআই-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমর্থিত।
২০২২ সালের জুলাইয়ে ফরটিফাই রাইটস দেখতে পায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নীরবে আরসিআই–এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে এবং প্রতিবেদনের একটি বাহাসা মালয়েশিয়া সংস্করণ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়ে গেছে। প্রতিবেদনের একটি ইংরেজি সংস্করণ সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ ছিল কিন্তু সেপ্টেম্বরের শুরুতে সেটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দুটি সংস্করণই ফরটিফাই রাইটসের সঙ্গে ফাইলে রয়েছে।
আরসিআই–এর রিপোর্টে দেখা গেছে যে, মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি পাচারের শিকারদের নির্যাতন ও মৃত্যু রোধ করতে পারতেন। কিন্তু সরকারি অবহেলা রোহিঙ্গা ও অন্যদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার জন্য দায়ী মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের শনাক্তকরণ ও সঠিক তদন্তে বাধা সৃষ্টি করেছে।
আরসিআই-এর প্রতিবেদনে বিস্তারিত এক উদাহরণে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের প্রাক্তন প্রধান খালিদ বিন আবু বকর প্রাথমিক আবিষ্কারের পরে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ওয়াং কেলিয়ানে পাওয়া মানুষের দেহাবশেষের উত্তোলন ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করেছিলেন।
ফলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ১১৪ ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র দুজনের মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করতে পেরেছেন, যা শেষ পর্যন্ত দায়বদ্ধতার প্রচেষ্টাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধা দিয়েছে।
ফরটিফাই রাইটস বেঁচে থাকাদের সাক্ষ্যও নথিভুক্ত করেছে যা পাচারকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
২০১৭ সালে থাইল্যান্ড রোহিঙ্গাদের পাচারসংক্রান্ত অপরাধের জন্য একজন ঊর্ধ্বতন সেনা জেনারেল এবং অন্য আট সরকারি কর্মকর্তাসহ ৬২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
অন্যদিকে মালয়েশিয়ার আদালত ওয়াং কেলিয়ানে ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত গণকবরের সঙ্গে যুক্ত পাচার-সম্পর্কিত অপরাধের জন্য মাত্র চারজন অ-মালয়েশিয়ান ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
ফরটিফাই রাইটস বলেছে, মালয়েশিয়ার নতুন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পুলিশ কনডাক্ট কমিশনের (আইপিসিসি) ওয়াং কেলিয়ানের সরকারি অপরাধমূলক অবহেলার তদন্ত শুরু করা উচিত।
২০২২ সালে পাস হওয়া আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন পুলিশ আচরণ কমিশন—আইপিসিসি আইন আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে৷
আইপিসিসির দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সততা প্রচার, জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা, অসদাচরণ মোকাবিলা এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযোগগুলো তদন্ত করা।
তবে মালয়েশিয়ার সুশীল সমাজ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, আইপিসিসি পুলিশের অন্যায়ের তদন্তে নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবে না।
২০১৭ সালে মালয়েশিয়া অ্যান্টি-ট্রাফিকিং ইন পারসন অ্যান্ড স্মাগলিং অব মাইগ্রেন্টস অ্যাক্ট পাস করে। যা মানব পাচারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এবং প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের তদন্তের দায়িত্বের বিবরণ দেয়। মালয়েশিয়ার পেনাল কোড ২০১, ২১৭ ও ২১৮ ধারার অধীনে সরকারি অবহেলার জন্য ফৌজদারি দণ্ডও নির্ধারণ করে।