মুসলমানদের বিরুদ্ধে উন্মত্ত সহিংসতা শুরু হয়েছিল হিন্দু জনতা কর্তৃক উস্কানিমূলক গান বাজানোর মাধ্যমে। এর প্রতিক্রিয়ায় রীতিমতো যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। আশপাশের মুসলমান এলাকাগুলোর ফুটপাতে ভাঙা কাচ পড়ে ছিল, পোড়া যানবাহন এবং পোড়া মসজিদগুলো সহিংসতার সাক্ষ্য দিচ্ছিল।
১০ এপ্রিল উদযাপনকারীরা মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের খারগোন শহরে তলোয়ার ও লাঠিসোঁটা নিয়ে মুসলমান এলাকা এবং মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ায় ভগবান রামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত হিন্দু উৎসব হঠাৎ সহিংস হয়ে ওঠে। ভিডিওগুলোতে তাদের শত শত লাউডস্পিকার থেকে বাজানো গানের সঙ্গে নাচ এবং উল্লাস করতে দেখা যায়। যাতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার আহ্বান জানানো হচ্ছিল।
শিগগিরই হিন্দু ও মুসলমানদের দল একে অপরের দিকে পাথর ছুড়তে শুরু করে বলে পুলিশ জানায়। সহিংসতা যতক্ষণে থামে, ততক্ষণে মুসলমানরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মসজিদগুলোকে নোংরা করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাতারাতি কয়েক ডজন পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়।
মসজিদের কর্মকর্তা হিদায়াতুল্লাহ মনসুরি বলেন, “মাত্র এক দিনেই আমাদের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে”।
এটি ছিল ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আক্রমণের সর্বশেষ ঘটনা, যেখানে কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে একটি কঠোর মুসলমান বিরোধী অবস্থানকে সমর্থন করে আসছে এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রচার করেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমানভাবে, মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে উস্কানিমূলক গানগুলো এই হামলার পূর্বাভাষ হয়ে উঠেছে।
ভারতে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলমান। কয়েক মিলিয়ন ভারতীয় মুসলমানের জন্য এই গানগুলো সারা দেশে মুসলমান বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির স্পষ্ট উদাহরণ। তারা শঙ্কিত এই ভেবে যে, ঘৃণামূলক সংগীত তাদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে আরেকটি হাতিয়ার।
“এই গানগুলো আমাদের হত্যার জন্য খোলামেলা আহ্বান জানায় এবং কেউ তাদের থামাতে চায় না”, মনসুরি বলেন।
খারগোনে সহিংসতায় একজন মুসলমান নিহত হয় এবং সাত দিন পরে তার লাশ পাওয়া যায়, বলেন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা অনুগ্রহা পি। তিনি বলেন, পুলিশ দাঙ্গার দায়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে উস্কানিমূলক গান বাজানো কেউ ছিল কি না তা নির্দিষ্ট করা যায়নি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের মাধ্যমে ভারত ভাগের সময় থেকে রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে আসছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে ধর্মীয় মেরুকরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রায়শই তাদের খাদ্য ও পোশাক শৈলী থেকে আন্তধর্মীয় বিবাহসহ সবকিছুর জন্য লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
ঘৃণাসূচক সংগীতগুলো উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, কিন্তু এই গানগুলোর নির্মাতারা এগুলোকে তাদের ধর্মের প্রতি তাদের ভক্তির রূপ এবং “গর্বিত হিন্দু” হওয়ার নিছক দাবি হিসেবে দেখেন।
“ভারত একটি হিন্দু দেশ এবং আমার গান আমাদের ধর্মকে উদযাপন করে। এতে দোষ কী?” বললেন গায়ক সন্দীপ চতুর্বেদী।
সহিংসতার আগে খারগোনে বাজানো অনেক গানের মধ্যে চতুর্বেদীর গান ছিল সবচেয়ে উত্তেজক। এই গানটি হিন্দুদেরকে “পুনরুত্থানের” আহ্বান জানায়, যাতে “যারা মাথায় টুপি পরে তারা প্রভু রামের কাছে মাথা নত করে”, যেটা স্বভাবতই মুসলমানদের উদ্দেশ করে বলা। এতে আরও বলা হয়, হিন্দুর “রক্ত জ্বলে উঠলে” “তলোয়ার” দিয়ে মুসলমানদের তাদের সঠিক স্থানে পাঠানো হবে।
চতুর্বেদী একজন স্বস্বীকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদী। তার কাছে গানের কথাগুলো ঘৃণাপূর্ণ বা উত্তেজক নয়। গানগুলো বরং "মানুষের মনোভাব" প্রকাশ করে।
নয়াদিল্লিভিত্তিক একজন সাংবাদিক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, তিনি মোদির জীবনী লিখেছেন, বলেছেন যে, ঘৃণামূলক গানগুলো ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা অডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে প্রচার করত। জনপ্রিয় বলিউড সংগীতের সুরে এই গানগুলো বানানো এবং এগুলো তরুণদের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করতে সাহায্য করত। ওই দশকের শুরুতে ১৯৯২ সালে ভারতের ডানপন্থীদের সহিংস প্রচারণার ফলে হিন্দু জনতা ১৬ শতকের একটি মসজিদ ধ্বংস করে এবং ওই ঘটনা মোদির দলকে জাতীয় খ্যাতি অর্জনে সাহায্য করে।