ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের নাবিকদের সুস্থ ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।বুধবার (১৩ মার্চ) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
অপহরণ হওয়া জাহাজ উদ্ধারে অগ্রগতি জানতে চাইলে নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, “যেকোনো মূল্যে আমাদের নাবিকদের আমরা বাংলাদেশে ফেরত আনতে বদ্ধপরিকর।”
এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বলেন, এখন পর্যন্ত থাকা খবর অনুযায়ী নাবিকরা সুস্থ এবং ভালো আছেন।
“পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমরা এই বিষয়ে অবহিত করেছি। জাহাজ উদ্ধার করার জন্য আমরা সকলের সহযোগিতা চেয়েছি। আমরা প্রথম যে বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি, সেটা হচ্ছে, জাহাজে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন, সেই ২৩ জন নাবিকের জীবন নিরাপদ রাখা, জীবন রক্ষা করে তাদেরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসা হচ্ছে আমাদের প্রথম কাজ;” বলেন খালিদ মাহমুদ।
ডিপার্টমেন্ট অফ শিপিং এবং মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট যতগুলো উইং আছে সকলে সমন্বিতভাবে কাজ করছে বলে জানান তিনি।
জাহাজ উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভারত যে সহযোগিতা করবে, তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক উইং গুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে খালিদ মাহমুদ বলেন, জাহাজটি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে, তাই সময়টা এখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না।
জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কিছু সংগঠন আছে। জলদস্যুদের সঙ্গে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ আছে।”
“অলিভিয়া বন্দরে আমাদের জাহাজ আটকে পড়ার পর, আমরা কিছু কিছু পয়েন্টের সহযোগিতা নিয়েছি, সেখানে সফলতা পেয়েছি। যেকোনো মূল্যে আমাদের নাবিকদের বাংলাদেশের ফেরত আনতে আমরা বদ্ধপরিকর;” তিনি যোগ করেন।
সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজ জিম্মি করেছে বলা হলেও, তারা সোমালিয়ার কি না, তা এখনো ‘আইডেন্টিফাইড’ করা যায়নি বলে জানান নৌপ্রতিমন্ত্রী।
মুক্তিপণ না দিলে জিম্মিদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে জলদস্যুরা, এমন তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমাদের কাছে এই ধরনের সংবাদ এখন পর্যন্ত আসেনি।”
নাবিকদের পরিবার উদ্বিগ্ন; এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এসব পরিবারের সদস্য সেখানে আটকে আছে। তাদের কীভাবে দিন কাটছে, তা আমরা অনুভব করছি। প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যান্য জায়গাগুলোতে তিনি কথা বলেছেন। নাবিকদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।”
জাহাজের অফিসে স্বজনদের ভিড়
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’কে সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বুধবার (১৩ মার্চ) দুপুর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে, জাহাজটি তখন উপকূল থেকে প্রায় ২৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিলো এবং সোমালিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো।
এদিকে, মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর আগে জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মো. আতিকউল্লাহ খান একাধিকবার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জানিয়েছেন সেখানের সর্বশেষ পরিস্থিতি।
জাহাজে জিম্মি হওয়া কয়েকজন নাবিকের পরিবারের সদস্যরা বুধবার সকাল থেকে জাহাজ মালিকের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের গোসাইডাঙ্গায় অবস্থিত কেএসআরএম অফিসে জড়ো হয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারের জন্য দ্রুত পদক্ষপ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন।
এ সময় জিম্মি নাবিক আব্দুর রশিদ ও আতিকুল্লাহ’র স্ত্রী-সন্তানরা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিমের সঙ্গে দেখা করে তাদের উৎকণ্ঠার কথা জানান। মেহেরুল করিম দ্রুত সময়ের মধ্যে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
জাহাজ সম্পর্কে কিছু তথ্য
মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর জাহাজটির গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার ছিলো। রাত ১১টায় জাহাজটি ট্র্যাকিং অর্থাৎ নজরদারির বাইরে চলে যায়।
কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি পুরোপুরি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে কোম্পানির কাছে বার্তা পাঠানো হয়। এছাড়া নাবিকদের একাধিক অডিও বার্তায় অস্ত্রসহ জলস্যুদের জাহাজ দখলের কথা জানা যায়।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন এনাম জানান, জাহাজে থাকা নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কথা হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ আছেন। জলদস্যুরা নাবিকদের জাহাজের কেবিনে রেখেছেন। এরপর আর কোনো কথা হয়নি।
জলদস্যু নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর জাহাজ থেকে মঙ্গলবার অডিও বার্তায় মো. আতিকউল্লাহ খান মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের কর্মকর্তাদের কাছে অবশিষ্ট খাবারের পরিমাণের উল্লেখ করে জানান, তাদের জাহাজে ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি ও ২০ থেকে ২৫ দিন খাওয়া যাবে এই পরিমাণ খাবার রয়েছে। দ্রুত যাতে খাবার শেষ না হয়, সেজন্য অপ্রয়োজনী ব্যবহার না করতে জাহাজের সবাইকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে, স্ত্রীর কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় জিম্মি আতিক বলেছিলেন, “আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিও।”
নাবিক জয়ের কথা
সোমালীয় জলদস্যদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহতে কর্মরত নাটোরের জয় মাহমুদের পরিবারের প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে উৎকন্ঠায়। অর্ডিনারি নাবিক হিসাবে কর্মরত জয় মাহমুদের বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সালাইনগর গ্রামে।
জলদস্যুদের কবলে পড়ার মুহূর্তে জয় তার চাচাতো ভাই মারুফকে জানিয়েছিলেন পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা। তবে বাবা-মাকে জানাতে নিষেধ করেছিছেন। কিন্তু চাপা থাকেনি সে কথা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মাধ্যমে খবর পায় পরিবার। একমাত্র ছেলের বন্দীদশার কথা শোনার পর থেকে বাবা জিয়াউর রহমান ও মা আবিদা বেগমের চোখে ঘুম নেই। তারা চান তাদের সন্তানসহ জাহাজের সবাইকে উদ্ধারে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার ও জাহাজ কর্তৃপক্ষ।
নাটোরের জয় মাহমুদ গত বছরের ২৯ নভেম্বর জাহাজটিতে যোগদান করে। জাহাজে জিম্মি ২৩ জনের মধ্যে চট্টগ্রামের ১১ জন, নোয়াখালীর ২ জন। এছাড়া নাটোর, নওগাঁ, ফরিদপুর, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, নেত্রকোণা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও খুলনার নাবিক রয়েছেন।
উল্লেখ্য, কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। জাহাজটিতে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন।