একটানা অবরোধের কারণে, বাংলাদেশে চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। অবরোধের মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে। বিশেষ করে যাদের বাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একটু দূরে, তারা সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন না। এদিকে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা আসন্ন, সে সব প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য হচ্ছে।
গত ২৯ অক্টোবর বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়েছে। এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে তিন দিনের অবরোধ শেষে ফের ৫ ও ৬ নভেম্বর দুদিনের অবরোধ চলছে। এমন রাজনৈতিক কর্মসূচির কারতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর রাজনৈতিক চলমান কর্মসূচি নভেম্বর মাসে আরও কঠোর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে, নভেম্বর মাসের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া, নভেম্বর শেষে অথবা ডিসেম্বর মাসেই স্কুলগুলোতে নতুন বই পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে নভেম্বর মাসটি শিক্ষা ক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অবরোধের কারণে এসব কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর ও জেলা সদরে হরতাল-অবরোধের প্রভাব বেশি পড়ছে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসায় বেশি ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা। গ্রামগঞ্জে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রভাব খুব বেশি না থাকলেও, সারা দেশের স্কুল-কলেজ একই শিক্ষাপঞ্জি মেনে চলে।
গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা হয় শহরের স্কুলগুলোর কাছাকাছি সময়ে ।শহরাঞ্চলের স্কুলগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রশ্নপত্র তৈরি করে। কিন্তু, গ্রামাঞ্চলে এখনো বেশ কিছু স্কুল একসঙ্গে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়; অথবা শিক্ষকদের সমিতি প্রশ্নপত্র তৈরি করে, স্কুলগুলো প্রশ্নপত্র কিনে নেয়।
এজন্য, মফস্বলে একেক স্কুলের একেক দিন পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ নেই। ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর ওপর হরতাল-অবরোধের প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে, বেশ কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হরতাল ও অবরোধের দিন বন্ধ রেখে, অন্য বন্ধের দিন এবং শুক্রবার ও শনিবার স্কুল খোলা রাখছিলো। অনেক স্কুল ৫ ও ৬ নভেম্বর অবরোধে কারণে ফিজিক্যাল ক্লাস না করে, অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে।
বসুন্ধরায় অবস্থিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ‘প্লে-পেন’ এর শিক্ষার্থীর অভিবাবক সরোয়ার আলম বলেন, “একটানা অবরোধের কারণে বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে, তাই না বাসা থেকে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। শারীরিক উপস্থিতিতে ক্লাস আর অনলাইন ক্লাসের অনেক ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আবার চলতি মাসে ১০ নভেম্বর থেকে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা হবে। পরীক্ষা কীভাবে হবে বলতে পারছি না।”
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, “আগামী ৯ নভেম্বর থেকে স্কুলগুলোর বার্ষিক মূল্যায়ন শুরু হবে। আমরা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করতে চাই। কোনো বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করতে, বেশ আগেই একটি সময়সূচি নির্ধারণ করে দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে ৫ নভেম্বর থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হওয়ার কথা ছিলো। তা পিছিয়ে ৯ নভেম্বর থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তবে এখনো পরীক্ষা শেষ করার সময় ৩০ নভেম্বর রাখা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য দুই পরীক্ষার মধ্যে সময় কমে আসবে। গত ৩০ অক্টোবর এ সংক্রান্ত সংশোধিত চিঠি স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
অভিভাবকরা বলছেন, তারা বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়েই সন্তানদের স্কুলে নিয়ে আসছেন। বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রুহুল আমীন। তিনি বলেন, “আমার দুই সন্তান বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। আগের দফায় হরতাল-অবরোধে তাদের স্কুলে আসতে দেইনি। এক সপ্তাহ স্কুল করেনি। এখন আবার অবরোধ। এভাবে কতদিন চলবে কে জানে। এজন্য আবার তাদের স্কুলে নিয়ে এলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে, কখন কী হয়।”
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ সুজন বলেন, “চলতি মাসেই বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। এরমধ্যে হরতাল এবং একটানা অবরোধে অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আমরা শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে ভয় ও উদ্বেগে আছি।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বিতীয় দফায় বিএনপির অবরোধের প্রথমদিন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসার প্রধান শাখা এবং বসুন্ধরা শাখা, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়, রাজউক উত্তরা, বনানী বিদ্যানিকেতনসহ রাজধানীর প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিলো কম।