বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমনের ছয় বছর পরও দেশটির সরকার তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে, কিছু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে তাদের একীভূত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) বলেছে, শরণার্থীরা মানবিক সহায়তা হ্রাসের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে চায় না। আর, এটি কেবল তাদের নিজস্ব কিছু প্রয়োজন মোকাবলা করার ক্ষমতা দিতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন “রোহিঙ্গারা তাদের নিজভূমিতে ফিরে যাওয়ার পর, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি মিয়ানমারের প্রতি এই আহবান জানান। বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে তারা (রোহিঙ্গারা) নিজ দেশে ফিরে যাবে। মিয়ানমারও তাদের ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছুক।”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিযান শুরু করে। তারা পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়; আর, লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, “রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সরকার দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। আলোচনা চলছে। আমরা সবসময় আশাবাদী। কিছু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নে এবং তাদের এখানে রাখার সুপারিশ করেছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই বিপুল জনসংখ্যা রয়েছে এবং অন্যান্য দেশের বিপুল সংখ্যক লোকের প্রয়োজন নেই। রোহিঙ্গারা ১৯৭০, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে এসেছিলো। তারা সব সময়ই এসেছে, এমনকি অতীতে সামরিক শাসনের আমলেও এসেছে।”
এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের জন্য সমাধান খুঁজতে মানবিক প্রতিক্রিয়া এবং রাজনৈতিক সমর্থন বজায় রাখতে আর্থিক সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে নতুন করে প্রতিশ্রুতি আহ্বান জানিয়েছে।
ইউএনএইচসিআর বলেছে, এই সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশু বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ছয় বছর পূর্ণ হচ্ছে। তারা, বাংলােদেশে আগে আশ্রয় নেয়া আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগ দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী বন্দোবস্তে মানবিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এই দীর্ঘায়িত সংকটকে ঘিরে চ্যালেঞ্জগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, তহবিলের তীব্র হ্রাস, মানবিক সহায়তায় ভূমিকা পালনকারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনের দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করছে। এটি প্রথমবারের মতো উদ্বাস্তুদের খাদ্য সহায়তা হ্রাসের দিকে পরিচালিত করেছে। সংস্থাটি আরো বলেছে, এই নাটকীয় পরিণতি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ জাগিয়েছে। উদ্বেগগুলোর মধ্যে রয়েছে, ক্রমবর্ধমান অপুষ্টি, স্কুল ড্রপআউট, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা। এর পরও, শক্তি এবং স্থিতিশীলতার সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা গত ছয় বছরে মানবিক প্রতিক্রিয়ার মেরুদণ্ড তৈরি করেছে এবং তাদের আতিথেয়তাকারী সম্প্রদায়গুলোকে সমর্থন করেছে।
ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উপকৃত করতে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, এটি শুধুমাত্র শরণার্থীদের তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য সজ্জিত করবে না বরং বাংলাদেশে তাদের মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং উৎপাদনশীলতাও নিশ্চিত করবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) বলেছে, শরণার্থীরা মানবিক সহায়তা হ্রাসের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে চায় না। আর, এটি কেবল তাদের নিজস্ব কিছু প্রয়োজন মোকাবেলা করার ক্ষমতা দিতে পারে।ইউএনএইচসিআর বলেছে, মিয়ানমারে একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবর্তন এই সংকটের প্রাথমিক সমাধান হিসাবে রয়ে গেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিয়মিত বলে আসছে যে তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়; তবে, যখন তাদের পক্ষে স্বেচ্ছায় তা করা নিরাপদ হবে।
জাতিসংঘের সংস্থাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটি সম্ভব করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা নবায়ন করতে হবে। তারা আরো বলেছে, “যেহেতু জাতিসংঘ টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত রয়েছে।”
ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা সম্মিলিত লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাদের আদি বা পছন্দের জায়গায়, অবাধে চলাফেরা করতে এবং তাদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য নথিপত্র, নাগরিকত্বের পথ, পরিষেবা এবং আয়-উন্নতির সুযোগে প্রবেশধিকারের বিষয়ে সক্ষম করতে হবে।
ইউএনএইচসিআরেউল্লেখ করেছে যে, যতক্ষণ না তারা ফিরে আসতে পারে, তারা বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে থাকছে। যেগুলো ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস, আগুনের প্রাদুর্ভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ইউএনএইচসিআর একটি জলবায়ু কর্ম কৌশলকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। যা আবহাওয়া এবং অগ্নি-প্রতিরোধী শরণার্থী আশ্রয়ের উপকরণগুলোর জন্য সমর্থন করে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্নির্মাণের খরচ ব্যাপক হারে হ্রাস করতে পারে।
দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আতিথ্য করে, বাংলাদেশ মানবিক প্রতিশ্রুতি এবং উদারতা প্রদর্শন করেছে যা অবশ্যই রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশি স্বাগতিক সম্প্রদায় উভয়ের জন্য অব্যাহত বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বীকার করা উচিত।
ইউএনএইচসিআর বলেছে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জেনেভায় গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির সমর্থনে অঙ্গীকারের মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের তাদের সমর্থন এবং প্রতিশ্রুতি প্রসারিত করতে উৎসাহিত করা হয়।”
রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় বাংলাদেশিসহ প্রায় ১০ লাখ ৪৭ হাজার মানুষকে সহায়তা করতে মানবিক সংস্থাগুলো এ বছর ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের আবেদন করেছে। ২০২৩ সালের আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত, যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার জন্য তহবিল এই আবেদনের মাত্র ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। যা একটি বৃহত্তর মানবিক সংকট রোধে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পূর্বাভাসযোগ্য আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার হতাশাজনক চিত্র।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক নৃশংস অভিযান শুরু করার ছয় বছর পর, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার খুব কম সম্ভাবনার সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের জেনারেলদের জবাবদিহি করতে ব্যর্থ হয়েছে।