অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র


ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র
ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র

সোমবার ৩১ জুলাই রাত থেকে ভারতের হরিয়াণায় শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। চার দিন পরেও নিভছে না হিংসার আগুন। হরিয়াণার নুহতে ঘটনার সূত্রপাত। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী দিল্লির পার্শ্ববর্তী গুরুগ্রামেও। অগ্নিগর্ভ অবস্থা ক্রমশ কঠিন হচ্ছে নুহ, গুরুগ্রামের মতো জায়গায়।

কোনও ক্রমে প্রাণ বাঁচল শিশুকন্যা সহ মহিলা বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের

নুহে একজন অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল উন্মত্ত জনতা, সেই খবরও সামনে এসেছে।

সূত্রের খবর, সোমবার দুপুরে সেই জেলায় একটি ধর্মীয় মিছিল বের হয়েছিল। ওই একই সময় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অঞ্জলি জৈনের গাড়ি। তার তিন বছরের কন্যাসন্তানও তখন গাড়িতেই ছিল। সরকারি আধিকারিকের গাড়ি দেখা মাত্রই তা ঘিরে ধরে সবাই। এরপর তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবে কোনওমতে গাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে প্রাণে বাঁচেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট। মঙ্গলবার ঘটনাটির কথা জানা গেলে কথাসিটি নুহ থানার পুলিশ এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে।

শুধু তাই নয়, হামলাকারীরা তাদের দিকে ঢিল, পাথরও ছোড়ে বলে অভিযোগ। কোনওরকমে সেখান থেকে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসে নুহের পুরনো বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি ওয়ার্কশপে আশ্রয় নেন অঞ্জলি জৈন। পরে কয়েকজন আইনজীবী তাদের উদ্ধার করেন। পরে এফআইআর-এ অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, “ওই উন্মত্ত জনতার দল তাদের দিকে ঢিল ছুঁড়ছিল। কিন্তু তা গায়ে লাগেনি। গাড়ির পিছনের কাছে পাথরের আঘাত রয়েছে।”

এরপর তার আরও অভিযোগ, “আমাদের দেখতে পেয়েই অভিযুক্ত দুষ্কৃতীরা গুলি চালাতে শুরু করে। কোনওরকমে সেসময় আমরা চারজনই গাড়ি ফেলে পালাই। আমি, আমার মেয়ে, গাড়ির চালক ও একজন দেহরক্ষী একটি পুরনো ওয়ার্কশপে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। পরে কয়েকজন উকিল আমাদের উদ্ধার করেন। মঙ্গলবার গাড়ির খোঁজ করতে গিয়ে শুনি, তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ওই দুষ্কৃতীরা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আপাতত তাদের শনাক্তকরণের কাজ চলছে।"

দাঙ্গার কবলে পড়া হিন্দু বাবা-ছেলেকে বাঁচালেন মুসলিম পরিবার

দাঙ্গায় যখন পুড়ছে নুহ, সেসময় সেখানেই এক সম্প্রীতির ছবি দেখল দেশবাসী। নুহতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে আটকে পড়েন সাধারণ মানুষ। এমনই এক হিন্দু বাবা-ছেলেকে বাঁচাতে অশান্তির মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েন দুই মুসলিম পরিবার।

সোমবার করণ নামে এক ব্যক্তি ছেলেকে নিয়ে পিনানগাঁতে গিয়েছিলেন। তাঁরা যখন নুহতে পৌঁছন, ততক্ষণে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সেই হিংসার মাঝেই আটকে পড়েন করণ ও তাঁর ছেলে বিবেক। অসহায় হয়ে চারপাশ দেখেছিলেন তাঁরা। চারপাশে উত্তেজিত জনতা ছোটাছুটি করছেন, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে গাড়িতে, গোলাগুলি চলছে, বোমাও পড়ছে সমান তালে।

করণের কথায়, সেদিন তার ছেলেকে টার্গেট করেছিল বজরং দলের সদস্যরা। কারণ, বিবেকের পরনে ছিল কালো রঙের জামা। এমনকী তাদের গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে জানান করণ।

ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র
ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র

এখনও সোমবারের বিভীষিকা তাড়া করছে করণ ও বিবেককে। জ্বলন্ত গাড়ি থেকে কোনওমতে বেরিয়ে এসে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়তে থাকেন তারা। প্রাণ হাতে নিয়ে কোনওমতে ঢুকে পড়েন স্থানীয় এক বাড়িতে। সেখানে একটি মুসলিম পরিবারের বাস। তারাই বিবেক ও করণকে আশ্রয় দেয়। তিন ঘণ্টা সেই বাড়িতেই থাকেন করণরা।

শুধু তাই নয়, যাতে পরে রাস্তায় বেরিয়ে আর কোনও বিপদে না পড়েন তাই বিবেককে একটা নতুন শার্টও দেয় ওই মুসলিম পরিবার । তারাই পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে ওই দু’জনকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

এখানেই শেষ নয়। করণ তার ছেলেকে নিয়ে পরিচিত আর এক মুসলমান পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। হামিদ নামে ওই পরিবারের কর্তা ছিলেন করণের বন্ধুস্থানীয়। সেই বাড়িতেই বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় কাটান করণরা। হামিদ নিজে পরে করণদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসেন। করণ বলেন, "এই শত্রুতা শেষ হওয়া উচিত।"

কাজ, খাবার, টাকা কিছুই নেই - চরম বিপন্নতায় অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকরা, পাচ্ছেন হুমকি

হরিয়াণার এই সংঘর্ষে চূড়ান্ত বিপদে পড়ছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। গুরুগ্রাম ছাড়ার জন্য ঘনঘন হুমকি আসছে তাদের কাছে। অসহায় শ্রমিকদের ভরসা পুলিশ-প্রশাসন।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে হরিয়ানায় কাজের সন্ধানে এসেছেন শামিম হোসেন। ২৫ বছরের এই যুবকের বাইরে কাজ নেই, ঘরে খাওয়ার নেই, হাতে টাকা নেই। শুধু তিনি নন, শামিমের মতো আরও এমন ১০০টি পরিবারের সোমবার থেকে একই অবস্থা। তাদের মধ্যে ৮৫টি পরিবার গুরুগ্রাম ছেড়ে ফিরে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু শামিমের মতো ১৫টি পরিবারের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই!

কাঁদতে কাঁদতে শামিম বলেন, "আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় একদল লোক এসেছিল। আমাদের মতো যারা মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছি, তাঁদের গুরুগ্রাম ছাড়তে বলে গেছে। কিন্তু আমাদের কাছে ফিরে যাওয়ার মতো টাকা নেই। এমনকী মুদির দোকানে বিস্তর ধার, সেটা মেটানোর টাকাও নেই। ঘরে এক বছরের বাচ্চা রয়েছে, তাকে দু’বেলা খেতে দিতে পারছি না। প্রশাসনের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি আমাদের সাহায্য করুন, নিরাপত্তা দিন।"

শুধু পরিযায়ী শ্রমিক নন, তাদের বাড়িওয়ালাদের ওপরও চাপ দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। এলাকার মানুষ জানেন, এই হুমকি শুধু মুখের কথা নয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলায় এমনই এক বাড়িওয়ালার ওপর চড়াও হয়েছিল কয়েকজন। মারধর করা হয় তাকে। এখন তিনি হাসপাতালে ভর্তি।

ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র
ভারতে হরিয়াণায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ: সহিংসতা, সম্প্রীতি, অসহায়তার বাস্তব চিত্র

বিভিন্ন বাড়িতে যারা কাজ করেন, তাদের তদারক করার দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, "আমার আন্ডারে ৩০ জন কাজ করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে গত দু’দিন মাত্র ৪ জন কাজে আসছেন। তাদের মধ্যে একজনকে আবার সেদিন রাস্তায় ঘিরে ধরে মারধর করা হয়।" এরপরই তিনি বলেন, "আমরা সকলেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। বাড়ির বাইরে পা রাখতেই ভয় পাচ্ছি।"

শামিমের মা সোফিয়াও থাকেন ছেলের সঙ্গে গুরুগ্রামের সেক্টর ৭০ বস্তিতে। আতঙ্কে কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে তার। তিনি বলেন, "গতকাল রাতে ৬০ জন মতো লোক এসেছিল, আমাদের বাড়িওয়ালার কাছে। বলে গেছে, যত মুসলমান পরিবার আছে সবাইকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলতে। আমরা মাত্র ১৫-১৬টা পরিবার এখনও এখানে আছি। আমাদের কাছে টাকা নেই কোথাও যাওয়ার।"

শামিম বলেন, "মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বাড়ি থেকে গুরুগ্রামে ফিরেছি। কাজে যোগ দিয়েছি। তারপরই এই ঘটনা ঘটে গেল। আলিশান, আমার এক বছরের ছেলে খিদের জ্বালায় কাঁদছে। আমার স্ত্রীও দু’রাত সমানে কেঁদে চলেছে। কীভাবে আমাদের চলবে, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম নেই।"

কেউ কেউ আবার মনে করছেন, এটা ঝামেলায় তাদের মতো গরিবরাই বলি হচ্ছেন। দৈনন্দিন জীবনযাপনের নূন্যতম সামগ্রীটুকুর অভাব চোখে পড়ছে বস্তির ঘরে ঘরে।

গুরুগ্রামের ডেপুটি কমিশনার নিশান্ত যাদব জানান, "কিছু পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ পেয়েছি। এলাকায় পুলিশ পাঠানো হয়েছে। স্পর্শকাতর জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। চলছে রুটমার্চও।" পুলিশ প্রশাসন, ভয় না পাওয়া আশ্বাস দিচ্ছে, তবুও আতঙ্ক কাটছে না গুরুগ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে।

XS
SM
MD
LG