অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মণিপুর জনজাতি দাঙ্গা: তিন মাসে ৬ হাজার জিরো এফআইআর, নিখোঁজ বহু, আতঙ্কে অসহায় পরিবার


INDIA-MANIPUR/CONFLICT
INDIA-MANIPUR/CONFLICT

ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য মণিপুরে দুই জনজাতি গোষ্ঠীর দাঙ্গায় এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ দুই গোষ্ঠীরই বহু মানুষ।তাঁদের পরিবারের অসহায়তা অকল্পনীয়।

দিনটা ছিল ৬ মে। তখন সবে কুকি-মেইতেই সংঘর্ষ শুরু হয়েছে মণিপুরে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ৪৭ বছর বয়সি অ্যাটম সমরেন্দ্র সিং। পেশায় একজন সাংবাদিক, গবেষক এবং সমাজকর্মী সমরেন্দ্র সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। আজ ৩ মাস পরেও তাঁর আর কোনও খোঁজ মেলেনি। স্ত্রী কবিতা এখন ভয়ঙ্কর কোনও দুঃসংবাদের জন্য নিজের মন শক্ত করছেন।

শুধু সমরেন্দ্র নন, সেদিনই নিখোঁজ হয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে থাকা বন্ধু ইউমখাইবাম কিরণকুমার সিং। দুজনে গাড়ি চালিয়ে কাংপোকপি জেলার পাদদেশের সীমান্তবর্তী মণিপুর অলিম্পিক পার্ক সংলগ্ন সাহেবুং এলাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর থেকেই তাঁদের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বহু খোঁজাখুঁজির পরেও দুজনের সন্ধান মেলেনি আর।

এই দুজনই নয় শুধু, গত ৩ মাসে মণিপুরে জাতিদাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছেন। জীবিত বা মৃত, কোনও অবস্থাতেই তাঁদের খোঁজ মেলেনি। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের হওয়ার পর বিস্তর তল্লাশি অভিযান চালিয়েও এখনও পর্যন্ত কোনও সাফল্য পাওয়া যায়নি। রাজ্যজুড়ে ৬ হাজারেরও বেশি জিরো এফআইআর দায়ের হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সমরেন্দ্র নিজে সাংবাদিক হলেও চেয়েছিলেন, ছেলে বিজ্ঞানী হোক। মে মাসেই তাঁদের সপরিবারে শিলং চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমরেন্দ্র নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সেই সব পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়। তাঁর ছেলে অ্যাটম থোইহেনবা জানিয়েছেন, "আমার বাবা কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এবং চেয়েছিলেন যে আমি শিলংয়ে

ইসরো-র তরুণ বিজ্ঞানী প্রোগ্রামে যোগ দিই।" সমরেন্দ্র ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তাই তাঁর অবর্তমানে সংসার কীভাবে চলবে, ছেলের পড়াশোনারই বা কী হবে, ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছেন না কবিতা।

সমরেন্দ্রর কাকা অ্যাটম মেঘাজিৎ জনিয়েছেন, "অন্ততপক্ষে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পরিবারগুলিকে নমুনা দেওয়া উচিত যাতে আমরা শেষকৃত্যটুকু করতে পারি। কিন্তু মণিপুর সরকার তা করতেও দেবে না, আবার নিখোঁজদের খুঁজে বের করতেও পারছে না।"

সমরেন্দ্র এবং তাঁর বন্ধুর নিখোঁজ হওয়ার ঠিক দু মাস পরে, ৬ জুলাই ইম্ফলে আর একটি একইরকম ঘটনা ঘটে। কারফিউ শিথিল হওয়ার পরদিন সকালে ১৭ বছরের কিশোরী হিজাম লুওয়াংবি লিন্থোইঙ্গাম্বি নিট কোচিং ক্লাসে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে তার প্রেমিক ১৭ বছরের ফিজাম হেমানজিৎ বাইকে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। দাঙ্গা পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হচ্ছে ভেবে দুজনে একান্তে একটু সময় কাটাবে বলে ঘুরতে বেরিয়েছিল। কিন্তু তারপর দুজনের কেউই আর বাড়ি ফেরেনি। থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করার পরেও কোনও লাভ হয়নি।

অন্যদিকে, কিশোরীর প্রেমিক হেমানজিতের মোবাইলের শেষ লোকেশন পাওয়া গেছে এমন একটি অঞ্চলে, যেটি কুকি অধ্যুষিত। ওই এলাকাটি কিশোরের টিউশন কেন্দ্র থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। কিশোরী কিংবা তার তরুণ প্রেমিক, কারওরই খোঁজ মেলেনি। তাদের দেহও পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে কিশোর-কিশোরীকে ইম্ফল উপত্যকার নাম্বোল এলাকার দিকে যেতে দেখা গেছে।

কিশোরীর বাবা হিজাম কুল্লাজিৎ জানিয়েছেন, সাইবার ক্রাইম পুলিশ জানিয়েছে, শেষবার কিশোরীর ফোনের লোকেশন পাওয়া গেছে কোয়াকতায় এবং হেমানজিতের ফোনের লোকেশন লামদানে পাওয়া গেছে। দুটি জায়গা দুটি ভিন্ন জেলায় অবস্থিত – কোয়াকতা বিষ্ণপুর জেলায়, এবং লামদান চূড়াচাঁদপুরে, যেগুলি এবং একে অপরের থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

"ও ফিরে না আসায়, আমি ওকে ফোন করেছিলাম। ও ফোন ধরে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে জানিয়েছিল, নাম্বোলে আছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাম্বোলে গেল কেন। ও ঠিক কোথায় আছে সেটাও জানাতে বলেছিলাম, যাতে ওর বাবা গিয়ে ওকে নিয়ে আসতে পারেন," জানিয়েছেন কিশোরীর মা জয়শ্রী। তিনি খুপুম (নাম্বোল থেকে ২০ কিলোমিটার) থেকে সেই শেষবার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারপরেই তার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন তিনি।

দুজনেরই পরিবার এখন আতঙ্কে রয়েছে, যে তাঁদের সন্তানদের কোথাও আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। হেমানজিতের মোবাইলে এখন একটি নতুন নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। হেমনজিতের বাবা ফিজাম ইবুঙ্গোবি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, "ওই এলাকাটি প্রধান রাস্তা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার ভিতরে, তিদ্দিম রোড। কিন্তু পুলিশ সেখানে তল্লাশিতে যেতে সাহস পায় না।"
XS
SM
MD
LG