বাইরে তখন প্রবল ঝড়বৃষ্টি। মাথার কাছে ছেঁড়া জানালার পর্দাটা দুলে দুলে ফুলে উঠছে। সেইসঙ্গে ট্রেনের হুইসলের একটানা বিকট আওয়াজ। ঘুম ভাঙছে এক ছিপছিপে তরুণের। স্বপ্নালু চোখে খুলে আড়মোড়া ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলেন সেই তরুণ। ঘুম থেকে জাগা, এবং বৃষ্টিভেজার সেই দৃশ্য আজও অমলিন বাঙালির স্মৃতিতে। ওই কিছুক্ষণের দৃশ্যেই এক পুরোনো শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত বাসিন্দারা যেন নিজেদের একাত্ম করে ফেলেছিলেন। শিল্পের এক নতুন পথচলা শুরু হয়েছিল এই দৃশ্যের হাত ধরে। সে যাত্রা আজও চলছে। সে একাত্মতাও আজও অমলিন।
তারপর কেটে গেছে ছ’টা দশক। টালা ব্রিজের কাছে নিতান্তই আটপৌড়ে এলাকায় ছাদ-লাগোয়া সেই ছিপছিপে তরুণের ঘর এখন বদলে গিয়েছে বেমানান এক হলদেটে ফ্ল্যাটবাড়িতে। কিছুই আর আগের মতো নেই। সেই পুরোনো টালা ব্রিজও নেই। আগাপাশতলাই পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু ১৯৫৯ সালে টালা এলাকার এই বাড়িতেই শুরু হয়েছিল বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এক আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যময় অধ্যায়ের। বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘মাস্টারপিস’ অপু ট্রিলজির শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল এখানেই।
টালার রাজা শিউবক্স বাংলা লেনের সেই বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন এলাকার পুরোনো বাসিন্দা শিবজি প্রসাদ সাউ। উত্তরপ্রদেশ থেকে অনেক ছোটবেলায় কলকাতা এসেছিলেন। কিন্তু তিনি এখন আদ্যোপান্ত বাঙালি।
জানালেন, শাড়ি পরা শর্মিলা ঠাকুরের কথাই তাঁর বেশি মনে আছে। আর মনে আছে লম্বা একটা লোকের কথা। পরে জেনেছিলেন তিনিই বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। যিনি খুঁজছিলেন এমন একটা বাড়ি, যেটায় ‘অপু’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় টালা সেতু থেকে নেমে রেললাইন ঘেঁষে বাড়িতে হেঁটে আসতে পারবেন। বললেন, "শুটিংয়ের সময় এই এলাকায় হইহই পড়ে গিয়েছিল। আমরা তখন অনেক ছোট। কিছুই বুঝতাম না। তবে কিশোরী শর্মিলা ঠাকুরকে খুব মনে আছে। আর মনে আছে শুটিংয়ের বিভিন্ন দৃশ্য।"
তোমার অনুশোচনা হয় না?’ এই বলে শুরু হয়েছিল তাঁদের কথোপকথন। আজও বাঙালি মধ্যবিত্ত রোম্যান্টিসিজম উস্কে দেয় এই বাক্য। অপুর সংসার সিনেমার সেই বাড়িতে ঢোকার মুখেই সিঁড়ি আর একটা ঘর ছিল। তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়িটা নীচ থেকে ও ওপর থেকে, দু’দিক থেকেই দেখা যেত। সেই সিঁড়িতেই নবদম্পতি অপু-অপর্ণার অর্থাৎ সৌমিত্র ও শর্মিলার শট নেওয়া হয়। একথা জানালেন পাল্টে যাওয়া অপুর সংসারের গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাসিন্দা শিখা ব্যানার্জী।
তিনি বললেন, "অপুর সংসারের স্মৃতি ভাঙচুর হয়ে যাচ্ছে, খুব খারাপ লাগে। পাশেই আমাদের বাড়ি। নিজেদের বাড়িতে ঘর কম। তাই ছেলের বিয়ের পর থেকে এই ফ্ল্যাটে থাকছি। যখন শুটিং শুরু হয় তখন আমাদের বাড়ির ছাদের গাছের টব নিয়ে যেতেন সত্যজিৎবাবু। কাজ শেষ হলে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতেন।"
গর্বের সঙ্গে তিনি আরও বললেন, ‘আমার মাসতুতো বোন আর আমার ননদ অপুর সংসারে আছেন জানেন! যখন অপু বিয়ে করে আসে তখন ওঁরা শাঁখ বাজাচ্ছেন। ছবিতে দেখতে পাবেন। তবে ছবি শেষ হওয়ার পরেও সৌমিত্রবাবু একবার এসেছিলেন। শর্মিলা ঠাকুরও এসেছিলেন একটি তথ্যচিত্রের কাজে।’ হাত দিয়ে দেখালেন কোথায় অপুর ঘর ছিল। কোথা থেকে ট্রেন দেখা যেত।
টালা ব্রিজে সেই সময়ে ছিল কাঠের সিঁড়ি। তা বেয়ে নেমে আসত অপু। ডোমপাড়ার চারিদিকে শূকর। সেসব পেরিয়ে ছোট্ট একটা পাঁচিল টপকে যে রাস্তা দিয়ে সৌমিত্র ঢুকতেন তা এখন আর আগের মতো নেই। চক্ররেল চালু হওয়ার পরে ওই বাড়ির সামনে অনেক বড় পাঁচিল তুলে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। নববধূকে নিয়ে সেখানে ঘোড়ার গাড়ি করে এসেছিলেন অপু। রেলের পাঁচিলের জন্য সেই রাস্তা এখন রিকশাও ঢোকে না।
এলাকার লোকজন জানালেন, বাড়ির মালিক ছিলেন শান্তিপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। তিনি মৃত্যুর আগেই বাড়ি বিক্রি করেন। অপুর বাড়ি চলে যায় প্রোমোটারের হাতে। তাঁর মৃত্যুর পর মালিক হন তাঁর ভাগ্নী। জানা গেছে, ভাগ্নীর ছেলে বেঙ্গালুরুতে থাকেন। তিন বছর আগে পুরোনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাটবাড়ি। এই বাড়ির দোতলায় তাঁদের একটা ফ্ল্যাট রয়েছে।
পাশের বাড়ির এক মহিলা আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, "অপুর সংসারের ৫০ বছর উপলক্ষে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর ছবিও আছে। শুটিংয়ের বাড়িটা আমার খুব ভাল লাগত। ওই দেওয়াল আর আমার দেওয়াল একই ছিল। বাড়িটা সরকার সংরক্ষণ করতে পারত।"
পর্দার অপু না ফেরার দেশে চলে গেছেন গত বছরের নভেম্বরে। সেকথা মনে পড়তেই পড়ন্ত হেমন্তের বিকেলে নতুন করে দুঃখ চেপে বসছে এই এলাকার পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে।
অপুর স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার সাক্ষী টালা ব্রিজ তো অনেক পুরোনো হয়েই গিয়েছিল। তাই ফের নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে এই ব্রিজ। বাড়ির সামনে রেললাইন দিয়ে এখনও ট্রেন যাচ্ছে, সিনেমায় অপর্ণার রেলগাড়ি প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাওয়ার মতোই।
কিন্তু বদলে যাওয়া ‘অপুর সংসারে’র বাসিন্দারা এখনও মশগুল ছাদে চিলেকোঠার ঘরের সামনে তরুণী অপর্ণার কয়লা ভাঙা, ঠোঙা ফাটিয়ে ‘অপুকে ভয় দেখানো নিয়ে। অপু-অপর্ণার ঘর, অপর্ণার উনুন ধরানোর দেওয়াল, মান-অভিমান, খুনসুটি, সিগারেটের প্যাকেটের আবদার, স্নানের কলতলা— কিছুই আর নেই।
সাক্ষী হয়ে স্থির চেয়ে শুধু পুরোনো টালা ট্যাঙ্ক। সিনেমায় অপুও ট্রাজেডিক ভাবে সংসারছাড়া হয়। বাস্তবের অপু অর্থাৎ সৌমিত্রও আর নেই। কিন্তু অপুর বদলে যাওয়া বাড়ির গায়ে এখনও লেখা রয়েছে, ‘অপুর সংসার।’ সেখানেই হয়তো শুয়ে থাকা অপুর মাথার কাছে শূন্যতার ছেঁড়া পর্দাটা এখনও উড়ছে।